Tuesday, October 1, 2019

মুগ্ধতা না দায়িত্ব

                                                           

রওনক দ্রুত পানি ছিটায় রিমঝিমের মুখে। কিন্তু তবুও জ্ঞান ফেরে না। ভয় পেয়ে কোলে তুলে নেয় রিমঝিমকে। আর তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যায়।
পিছু পিছু আমেনা বেগম আর কেয়াও বেড়িয়ে পড়ে।
-
ডাক্তার জানায় প্রচন্ডরকম লো প্রেশার আর খাওয়া দাওয়া না করায় শরীর দূর্বল হয়ে পড়েছিল।
আর সবচেয়ে বড় কথা কোনো একটা কারণে রিমঝিম খুব শক পেয়েছে। তাই জ্ঞান ফিরতে লেইট হচ্ছে।
-
ডাক্তার রওনককে রিমঝিমের জন্য কিছু ফল আর দুধ আনতে পাঠায়।
রওনক দ্রুত চলে যায় সেগুলো আনতে।
-
রিমঝিমের জ্ঞান ফিরলে চোখ মেলে যখনই তাকায় তখনই রওনকের বলা কথাগুলো কানে ভেসে আসে। যে অর্ণবের জন্য এতদিন অপেক্ষা করেছে, আল্লাহ ওকেও নিয়ে গেল। সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছে এই কথাটা মনে পড়ে যে, রওনক ওকে দয়া করে বিয়ে করেছে, ভালোবেসে না। সারাজীবন ও দয়ার পাত্রী হয়ে থাকবে।
নিজের ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য যদি রিমঝিমকে দায়ী নাই ভাবত তাহলে অন্য মেয়ের সাথে কথা বলার মিথ্যা নাটক ওর সামনে ওকে কষ্ট দেয়ার জন্য করত না। এমনকি বিয়ের পর থেকে কখনোই ভালো ব্যবহার করে নি রওনক ওর সাথে।
বারবার শুধু রিমঝিমের একটা কথাই মনে হয়েছিল, "আমিই দায়ী সব কিছুর জন্য"।
-
চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু বর্ষণ হতে থাকল রিমঝিমের। তাই চোখ বন্ধ করে ফেলল।
-
ইতিমধ্যে রওনক ওর ক্লোজ ফ্রেন্ড আরিফকে সবটা খুলে বলে। আর ওর বাসা হাসপাতালের একদম কাছে হওয়ায় তাড়াতাড়ি রিমঝিমকে দেখতে চলে আসে।
-
কেবিনের দরজা খুলেই দেখতে পায় রিমঝিম শুয়ে আছে।
-রিমঝিম...
-কে...
কথার উত্তর দিয়েই বন্ধ চোখজোড়া মেলে দেয় আরিফের দিকে।
-আমাকে তুমি বড় ভাই মানতে পারো। তোমাদের বিয়েতে আমি ছিলাম। রওনকের বন্ধু।
-ও আচ্ছা। হুম ভাইয়া মনে পড়েছে।
-কেমন আছ এখন?
-জ্বি ভালো।
-তোমার শোনা অসমাপ্ত কিছু কথা আজ সমাপ্ত করতে এসেছি।
-মানে? বুঝলাম না ভাইয়া।
-তোমাকে রওনক যা বলেছে তা সম্পূর্ণ সত্য। তবে অনেক কথা ও লুকিয়েছে।
-কি কথা?
-
-রিমঝিম...মা আমার ঠিক আসিছ এখন?
আমেনা বেগম কেয়াকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে যান। ছেলের বউকে যেন মেয়ের জায়গাটাই দিয়ে দিয়েছিলেন। তাই রিমঝিমকে বেডে শুয়ে থাকতে দেখে নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারেন না। এসেই রিমঝিমের কপালে গালে চুমু দিতে থাকেন।
-মা আমার। তোকে ছাড়া যে আমার ঘরটাই ফাঁকা লাগে রে। তুই ঠিক আসিছ তো?
-হ্যাঁ মা। আমি ঠিক আছি। আপনি বসুন এখানে।
-আচ্ছা রিমঝিম আমি অন্য একসময় আসব।
-না ভাইয়া, আপনি আমাদের সবার সামনে বলুন। কথাগুলো আমাদের সকলেরই জানা দরকার।
-কিন্তু রওনক...
-ওনাকে আমি দেখে নিব। অনেক কষ্ট দিয়েছে এতদিন।
আপনিই সেই না? যে রাতে ফোন দিয়ে প্রেমিকার অভিনয় করতেন।
আরিফ মাথা নিচু করে হ্যাঁবোধক উত্তর দেয়।
-তাহলে বলুন আপনি। কি এমন কথা আছে যা রওনক আমাদের থেকে লুকিয়েছে?
-ঠিক আছে বলছি।
তোমার নিশ্চয়ই এটা মনে হচ্ছে যে, তোমাকে ও দয়া করে বিয়ে করেছে।
-হুম।
-কিন্তু না। ও তোমাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছে। যদিও ভাইয়ের দেয়া দায়িত্বের ভারে তোমার প্রতি ওর মুগ্ধতা ঢাকা দিয়ে রেখেছিল।
-কিহ? কিন্তু কিভাবে? উনি তো বিদেশ ছিলেন।
-হুম বিদেশ ছিল। কিন্তু অর্ণবের সাথে যে ও নিজেও বাংলাদেশে এসেছিল। এটা তো জানো?
-হ্যাঁ সে কথা তো বলেছিলেন।
- তোমার কি মনে পড়ে? তোমার রোজকার রুটিন ছিল দিপু মন্ডলের ফলের বাগান থেকে প্রতিদিন টিফিন পিরিয়ডে ফল চুরি করা।
-
শাশুড়ির সামনে কথাটা বলায় রিমঝিম লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ঘার নাড়ায়।
-সেদিন রওনক গ্রামটা ঘুরে দেখছিল। হঠাৎ দূর থেকে তোমায় দেখতে পায়। তোমায় প্রথম দেখেই ও ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু মেয়েদের সাথে কথা বলার অভ্যাস না থাকায় এগিয়ে যাওয়ার সাহস হয় না।
কয়েকদিন এভাবে চলার পর একদিন এসে অর্ণবকে বলে।
-অর্ণব শোন না।
-জ্বি ভাইয়া বলো।
-দিপু মন্ডলের ফলের বাগান চিনিস তো?
-হ্যাঁ, কেন?
-ওখানে কাল দুপুরে যাবি। একটা পরী দেখতে পাবি।
-ভাইয়া...তোমার পছন্দ?
- ভীষণ। কিন্তু তুই তো জানিস আমি মেয়েদের সাথে ঠিকভাবে কথা বলতে পারি না। তাই...
-হয়েছে আর বলতে হবে না। যাব কাল দেখতে যাও।
-
আর রওনকের সকল পছন্দের জিনিস অর্ণবের পছন্দের প্রথম কাতারে থাকত। এবারেও ভিন্ন হলো না।
তোমায় দেখে এসে রওনককে অর্ণব সরাসরি বলে, "ভাইয়া প্লিজ তুমি যা বলবে তাই করব। কিন্তু বেঁচে থাকলে ওকেই আমার বউ করে আনবা প্লিজ। মরে গেলে নাহয় তুমি বিয়ে করো। কিন্তু আমি ওকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। আমার চোখের সামনে তোমার বউ হয়ে আসলে আমি সহ্য করতে পারব না ভাইয়া।"
তখন ভাইয়ের জন্য নিজের ভালোবাসাকে মাটি চাপা দিয়ে দেয় রওনক। ছোটদের জন্য বড়রা সেক্রিফাইস করে। কিন্তু রওনকের এটা সারাজীবনের ব্যাপার ছিল যা ও নিজেকে কোনোভাবেই বুঝাতে পারছিল না।
তবুও যখন অর্ণবের পড়াশোনায় ভালো হওয়া দেখতে পেল তখন ভেবেই নিল ওর থেকে অর্ণবই তোমাকে বেশি সুখী রাখতে পারবে। তাই তোমার লাইফ থেকে সরে আসার চিন্তা করে। কিন্তু ভাগ্য হয়তো অন্যরকম কিছুই চাচ্ছিল। তাই তোমার সাথেই ওর বিয়েটা হয়ে গেল।
-
রিমঝিম খুশি হলো, অনেক খুশি হলো। তার মানে রওনক ওকে ভালোবাসে? ও বোঝা না রওনকের কাছে?
কিন্তু এটা ভেবে কষ্ট লাগছিল রওনক এতোগুলো বছর মনের ভিতর ভালোবাসা ভরে রেখেছিল। অথচ একটাবারও প্রকাশ করে নি।
-
-কিরে আরিফ তুই এখানে? তোকে কতোগুলো ফোন দিয়েছি দেখেছিস?
-ওহ স্যরি।
-রিমঝিম এগুলো খেয়ে নিও। আমার হাসপাতালে কাজ আছে। আমি যাচ্ছি। আরিফ চল।
-হুম চল।
দুজন চলে যায়। রওনকের ভয় আরিফ আবার না সব বলে দেয়। এতক্ষণ ছিল, বলছেই নাকি।
-ওই ব্যাটা, তুই এখানে কেন এসেছিস? বলছিস নাকি কিছু?
-আরে না।
-
-
রিমঝিমকে বাসায় আনতে আনতে রাত হয়ে যায়। আর ওদিকে রওনকও দেরিতে আসে।
রওনক এসে দেখে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ও চুপচাপ ফ্রেস হয়ে এসে না খেয়েই শুয়ে পড়ে। কিন্তু দুচোখে ঘুম আর আসে না।
ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে এপাশ ওপাশ করতে থাকে। মনে মনে ভাবে এখন যদি কেউ ওকে এক প্লেট খাবার এনে দিত।
সাথে সাথে টেবিলের উপর ভাত দেখতে পায়। চোখের ভুল মনে করে চোখ কচলে আবারও তাকায়। নাহ ভুল দেখে নি। প্লেটটা হাতে নিতে নিলেই রিমঝিন ছো মেরে নিয়ে নেয়।
-এটা আপনার জন্য না।
-তাহলে?
-আমার জন্য।
-ওহ।
-ঢং না করে ভালো মানুষের মতো বসেন এখানে। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
-কি? তুমি আমাকে খাইয়ে দিবে?
-চিন্তা কইরেন না। এই খাবারে বিষ নেই।
-আরে এটা কখন বললাম?
-হা করেন।
-হা...
রিমঝিম খাইয়ে দেয় আর রওনক চুপচাপ খেতে থাকে। রওনকের মনে হচ্ছে যেন অমৃত খাচ্ছে।
-আপনি তো বড্ড স্বার্থপর।
-আমি আবার কি করলাম?
-নিজে একাই খেয়ে যাচ্ছেন। যে খাইয়ে দিচ্ছে তার কোনো খোঁজ নেয়ার নেই।
-ওহ স্যরি। হা করো
-
খাওয়ার পর্ব শেষ করে দুজন ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়।
-জানেন তো আমার আগে খুব ইচ্ছা করত বিয়ের পর বরের বুকে ঘুমাবো।
-কেন? এখন ইচ্ছা করে না?
-
রিমঝিম অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে।
-মা...মানে?
-হুহ জেনেই যখন গেছ, এখনো কি দূরেই থাকবা?
-আপনি কিভাবে জানলেন?
-আরিফ সব বলে দিয়েছে।
-
রিমঝিম লজ্জায় লাল হয়ে যায়। কি বলে ফেলল এটা?
রওনক মাঝখানের বালিশটাকে ছুড়ে ফেলে দেয়। এক টানে রিমঝিমকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে ফেলে।
-এখনো কি অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখবে?
রিমঝিম লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলে। আর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রওনককে। দুজনেই ভালোবাসার সাম্রাজ্যে হারিয়ে যায়। এখন শুধু এক নতুন সকালের অপেক্ষা।
★★সমাপ্ত★★

No comments:

Post a Comment