প্রচন্ড বৃষ্টির মাঝেও এলিসা যত দ্রুত সম্ভব দৌঁড়াচ্ছে। কোনোভাবেই সে তার ক্যামেরা হাত ছাড়া করতে চাচ্ছে না। দ্রুত গতিতে দৌঁড়েও সে ছেলেগুলোর সাথে পেরে উঠছে না। অবশেষে একটা জাহাজের কন্টেইনার দেখতে পেয়ে, সেখানে গিয়েই লুকিয়ে পড়ল। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয় নি। কিছুক্ষনের মধ্যেই ছেলেগুলো তাকে খুঁজে পেয়ে যায়। কন্টেইনারের ভিতর একে একে প্রবেশ করে তারা।
"কি গো মামুনি, বেঁচে যাবে কোথায় শুনি?" ছেলেগুলোর মধ্যে একজন ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে এলিসার উদ্দেশ্যে কথাটি বলল।
"শোন, এতক্ষন ধরে আমাদের দৌঁড়িয়েছে, এবার একে না খেয়ে ছাড়লে হবে না।" দ্বিতীয় ছেলেটির মুখে এমন কথা শুনে, এলিসা ভয়ে চুপসে গেছে।
তার মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে, নিশ্চিত মৃত্যুর কথা।
আর ঠিক তখনই, আকাশে প্রচন্ড শব্দে বিদুৎ গর্জে উঠল। কন্টেইনারের প্রবেশমুখে ছেলেগুলোর ঠিক পিছনে, বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় একটা আবছা ছায়া দেখতে পেল এলিসা।
"দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। তা তোমরা তো মাত্র তিনজন।"
কথাটি বলেই হুহু করে হেসে উঠল অজ্ঞাত লোকটি। পিছন থেকে এমন কথা শুনে ছেলেগুলো ভীষনভাবে চমকে উঠল। পিছন ফিরে অন্ধকারে লোকটির চেহারা দেখার বৃথা চেষ্টা চালালো তারা। ছেলেগুলোর একজন অজ্ঞাত লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, "নিজের জান বাঁচাতে চাস তো এখান থেকে চলে যা। নাহলে অকালেই প্রাণ হারাবি।"
কিন্তু লোকটি সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। লোকটির কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া না দেখে, ছেলেগুলোর একজন কোমড় থেকে ছুড়ি বের করে এগিয়ে গেল লোকটির দিকে। লোকটির কাছে গিয়ে তার পেটে ছুড়ি চালানোর ঠিক আগ মুহুর্তেই, ছেলেটির তলপেটে প্রচন্ড জোরে এক লাথি এসে পড়ে। ছেলেটির শরীর তৎক্ষনাৎ উপরের দিকে উঠে যায়। তার মাথা গিয়ে গাথে কন্টেইনারের ছাউনিতে। বাকি দুইজন ছেলে লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখতে পায়, অন্ধকারের মাঝে বেগুনি রঙ্গের দুটি চোখ ও গলায় পরিহিত একটি লকেট জ্বলজ্বল করছে। কিছুক্ষনের জন্য মনে এক অজানা ভয় গ্রাস করে তাদের।
ছেলেগুলো কিছুটা সাহস জুগিয়ে এগিয়ে গেল লোকটির দিকে। লোকটির কাছে যেতেই, লোকটি তাদের দুজনের গলা দু হাত দিয়ে চেপে ধরে। উপরে উঠিয়ে মাটিতে আছাড় মারতেই, থ হয়ে পড়ে রইল মোট তিনটে নিথর দেহ। এদিকে এলিসা নিজের বাঁচার সুযোগ খুঁজছে। অজানা ব্যক্তির এমন আবির্ভাব, তার মনে সংশয়ের সৃষ্টি করেছে। এতকিছুর মাঝেও সে মনকে জানায়, সে আশার আলো খুঁজে পেয়েছে। ভীত সন্ত্রস্ত মনে এবার ভয়ের পরিমান কমা শুরু হল। এলিসা ভাবল, অজ্ঞাত লোকটি তার কাছে একজন ফেরেশতার রুপে এসেছে। তার ধারনা, বিধাতা তাকে বাঁচাতে ফেরেশতা পাঠিয়েছেন।
কিন্তু পরক্ষনেই লোকটির কথা শুনে, তার ধারনা পাল্টে গেল। লোকটি এলিসাকে প্রশ্ন করল, "আপনার কাছে থাকা ক্যামেরাটা কি দেখা যাবে?" এলিসা কি বলবে কিছুই ভেবে পাচ্ছিল না। মনে মনে ভাবল, 'এক বিপদ যেতে না যেতেই আরেক বিপদ শুরু, সবাই এই ক্যামেরার পিছনে লেগেছে কেন?' এলিসাকে চুপ দেখে লোকটি এলিসার দিকে ধীরপায়ে এগিয়ে যায়। ততক্ষনে তার জ্বলজ্বল করা চোখ ও লকেট, আর জ্বলছে না। এলিসার কাছে যেতেই এলিসা লোকটির চেহারা দেখতে পেল। চাপ দাড়ি, ছোট ছোট দুই চোখ, ফর্সা ত্বক, সিল্কি লম্বা চুল, পেশিবহুল স্বাস্থ্য আর গলায় ঝুলে থাকা এক লকেট।
লোকটি এলিসার দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "হেলো, আমি বেস্তে। এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম এই ছেলেগুলো আপনার পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে। তাই কি হয়েছে দেখতে ছুটে আসি এখানে। তারপর তাদের কথা শুনে বোঝতে পারি সব।" এলিসা লোকটির কথাগুলো শুনার পর তার বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরে হ্যান্ডশেক করল। "জ্বী চলুন বাইরে হেটে কথা বলা যাক।" এলিসাকে বলল বেস্তে
এলিসা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। এলিসাকে নিয়ে কন্টেইনার থেকে বেরিয়ে এল বেস্তে। তখনো তুমুল বৃষ্টি হচ্ছ। বৃষ্টির মাঝে হাটা শুরু করল দুজন। হাঁটতে হাঁটতে এলিসা বেস্তেকে প্রশ্ন করল, "তা ওই ছেলেগুলো তো ক্যামেরার পিছনে পড়ে ছিল। কিন্তু আপনি কেন ক্যামেরাটা চাইলেন, বুঝলাম না।" বেস্তে চেহারায় স্বাভাবিক ভাব রেখেই উত্তর দেয়, "আপনি যেভাবে আপনার ক্যামেরা জড়িয়ে ধরেছিলেন, এতে স্বাভাবিক যে কেউ বোঝবে যে ক্যামেরাতে কিছু আছে। আর এত রাতে এখানে কোনো ভদ্র ঘরের মেয়ে ক্যামেরা নিয়ে আসবে না।
আপনি নিশ্চয়ই একজন সাংবাদিক, যে কিনা এখানে স্মাগলার দের ছবি তুলতে এসেছেন।" বেস্তের এমন কথা শুনে এলিসা কিছুক্ষন তার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, "আমি যে স্মাগলারদের ছবি তুলতে এসেছি, তা আপনি কি করে জানলেন?"
- এই জায়গা লিভারপুলের সবচেয়ে নির্জন শিপইয়ার্ড। আর এদিকের প্রায় সব মানুষই এখানের স্মাগলিং এর ব্যাপারে অবগত। স্মাগলারদের একটা বড় গ্যাং রয়েছে, যা লিভারপুলের আন্ডারওয়াল্ড দখল করে বসে আছে। আর আমি এদিকটায় থাকি অনেকদিন ধরে। তাই এসব সম্পর্কে অল্প একটু জানি আর কি। আর আপনার মত অনেকেই সাহস করে তাদের ছবি তুলতে আসে। কিন্তু সবাই ভাগ্যবান হয় না।"
এলিসা বেস্তের কাছে এমন উত্তর শুনে খানিকটা লজ্জা পেল। কারন সে বুঝতে পারছে সে বোকার মত একটা প্রশ্ন করেছে। লিভারপুলের অধিকাংশ মানুষই এখানে ঘটে যাওয়া স্মাগলিং ও সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে অবগত। "তা আমি কি একটু দেখতে পারি ছবিগুলো?" মুখে হালকা হাসি রেখে এলিসাকে প্রশ্ন করে বেস্তে। "জ্বী অবশ্যই।" বলে ক্যামেরাটা তার দিকে বাড়িয়ে দেয় এলিসা। ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে বেস্তে এলিসাকে তার চোখের দিকে তাকাতে বলে। তারপর আর কিছুই মনে নেই এলিসার। হুশ ফিরার পর সে নিজেকে একটা শিপইয়ার্ডে আবিষ্কার করে। এতক্ষন যেন সে একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। সে এখানে কেন এসেছে তার কিছুই সে মনে করতে পারছে না। বাসায় এসে লিন্ডাকে ফোন দেয় এলিসা। লিন্ডা হচ্ছে এলিসার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী এবং সহকারী। লিন্ডাকে ফোন দিয়ে এলিসা জানতে পারে, সে সেখানে হওয়া স্মাগলিং ও স্মাগলার দের ছবি তুলতে গিয়েছিল। ইংল্যান্ডের একটি জনপ্রিয় পত্রিকায় কাজ করে সে। আর বসের নির্দেশ আসায় তাকে লিভারপুল আসতে হয়। এতটুকুই সে মনে করতে পেরেছে আপাতত।
কিন্তু এখানে আসার পর কি ঘটেছে তা তার মনে নেই। ক্যামেরার গ্যালারি চেক করে, স্মাগলারদের ও স্মাগলিং করার অনেকগুলো ছবিও সে খুঁজে পেয়েছে। তবে সে ছবিগুলো কখন তুলেছে তাও তার মনে নেই। এসব ভাবতে ভাবতেই বিছানার মাঝে তার শরীর এলিয়ে দেয়। ঘুমিয়ে পড়ে এলিসা।
লিভারপুলে নিজের কাজ শেষে রকিবকে ফোন দেয় বেস্তে। তাকে তৈরি হতে বলে বেরিয়ে যায় সে হোটেল থেকে। সেখান থেকে ট্যাক্সি করে সোজা এয়ারপোর্টে চলে যায় সে। এয়ারপোর্টে গিয়ে রকিবকে লাগেজ হাতে দাঁড়ানো দেখতে পায়। বেস্তে কে দেখেই রকিব তার দিকে এগিয়ে আসে। "আসসালামু অলাইকুম ভাই, এত জলদি কাজ শেষ?" বেস্তেকে হেসে প্রশ্নটি করে রকিব। "আমার কাজ এত তাড়াতাড়ি শেষ বলে খুশি লাগছে? নাকি ছুটি এত তাড়াতাড়ি শেষ বলে হাসছ?" রকিবের হাসি আরো বৃদ্ধি পায়। সে হেসে হেসেই বলে, "ভাইয়া, দুইটার কারনেই হাসছি। তবে আপনার কাজ যে এত জলদি শেষ হয়ে যাবে ভাবি নি। যদিও আমি জানি, আপনি কোনো কাজ শেষ করতে বেশি সময় নেন না।"
-হুম তাহলে চলো, এবার নিজ বাসস্থানে ফিরে যাওয়া যাক।
- জ্বী ভাই চলুন।
লিভারপুল থেকে লন্ডন এয়ারপোর্টে এসে নামে প্ল্যান। প্ল্যান থেকে নেমে সোজা তাদের বাসায় চলে যায় বেস্তে ও রকিব। কিংব্রিজের পাশে ছোট্ট একটা গলিতে, এক দোতলা বাসায় থাকে তারা। বহুবছর আগে এক বৃদ্ধের কাছ থেকে খুবই অল্প দামে বাসাটি কিনেছিল বেস্তে। নির্জন জায়গায় হওয়ায় ও বৃদ্ধের কোনো ছেলে মেয়ে না থাকায় খুবই অল্প দামে বিক্রি করে দেন বাসাটি। আর এত সুন্দর বাসা এত অল্প দামে পাওয়ায় বেস্তে এটাকে হাতছাড়া করতে চায় নি।
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে নিল তারা। তারপর ড্রয়িং রুমের চেয়ারগুলোতে বসে বেস্তেকে উদ্দেশ্য করে রকিব বলল, "ভাই, হাতে তো কোনো কাজ নেই, চলুন না আজ বিকেলে লন্ডন আই তে একটু ঘুরে আসি।"
"কাজ নেই কে বলেছে? নতুন চিঠি এসেছে সেটা তুমি আমাকে এখনো বলো নি কেন?" জানালার বাইরের ডাক বাক্সটির দিকে তাকিয়ে কথাটি বলল বেস্তে। "ভাই, এবারের চিঠি টাতে বিশেষ কোনো খবর নেই।" মুখে খানিকটা ভয় নিয়ে কথাটি বলল রকিব। যদিও সে জানে বেস্তে ঠিকই বোঝে গেছে তার মনের খবর। "তুমি জানো আমি মিথ্যে পছন্দ করি না, চিঠিটা নিয়ে এসো।" বেস্তের কথাটি শুনার সাথে সাথেই রকিব চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে চিঠিটা নিয়ে আসে। চিঠিটা হাতে নিয়ে মনোযোগ সহকারে পড়া শেষ করে বেস্তে। তারপর রকিবের দিকে তাকিয়ে বলে, "লন্ডন আই তে পরেও যেতে পারবো। এখন রেডি হয়ে নাও, বেরোবো।"
- ভাইয়া, মিস্টার এলেক্স কে যে ই খুন করুক না কেন, সে অনেক বড় মাপেরই গুন্ডা হবে। আপনি ভালো করেই জানেন, লন্ডনের অনেক বড় বিজনেসম্যান ছিলেন তিনি। আর পুলিশ এটাকে সুইসাইড কেইস বলে কেস ক্লোজড করে দিয়েছে। আমাদের এটাতে না জড়ালেও তো চলে।"
রকিবের কথা শুনে খিক করে হেসে ফেলল বেস্তে। তারপর রকিবের দিকে তাকিয়ে বলল, "তুমি কেন যে ভুলে যাও, আমি কে। শোনো রকিব, জ্যাক্স কখনো কাউকে ভয় পায় না। আমি জ্যাক্স, ডিটেকটিভ জ্যাক্স।"
চলবে।
গল্প: ডিটেকটিভ জ্যাক্স (এ মিস্ট্রিয়াস ম্যান)
পর্ব: ০১
লিখায়: সালমান চৌধুরী সুপ্রিয়।
No comments:
Post a Comment